ভোপাল গ্যাস দূর্ঘটনার স্মৃতি– বিজ্ঞানের আশির্বাদ প্রাপ্ত (?) এই পৃথিবীতে মানুষের অহংকার, ঔদ্ধত্য এবং গাফিলতির জন্য যত বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনা একটি অন্যতম। অনেকেই একে ইতিহাসের সর্বনিকৃষ্ট শিল্প বিপর্যয় বলে অভিহিত করেছেন। তারই স্মৃতি উস্কে ঘটে গেল আবারো বিশাখাপত্তনমে ভয়াবহ গ্যাস দুর্ঘটনা। বিশাখাপত্তনমের দক্ষিণ শহরতলির কাছে গোপালপত্তনম এলাকায় রয়েছে এলজি পলিমার ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড নামের ওই রাসায়নিক কারখানা। মূলত পলিয়েস্টার পলিথিন তৈরি হত ওই কারখানায়। সেই কাজে ব্যবহার করা হত স্টায়রিন নামের গ্যাস। যা মানব শরীরের পক্ষে বিষাক্ত।

এই ঘটনায় প্রায় হাজারেরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে জানা গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৮০০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ১১ জন ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছেন। মৃতের সংখ্যা আরো বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। রাজ্য সরকার, মৃতদের পরিবার পিছু ১ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে। মানুষ ছাড়াও গবাদি পশু এবং অন্যান্য প্রাণীদেরও প্রাণহানি ঘটেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এরকম দৃশ্যও দেখা গিয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে যে দুটি গরু মরে পরে আছে ।

তবে কি ঘটেছিল ভোপালে?
ভোপালের জনবসতির মধ্যেই ছিল একটি মার্কিন কোম্পানির ইউনিয়ন কার্বাইড-এর রাসায়নিক কারখানা। তৈরি হত উদ্বায়ী বিষাক্ত মিথাইল আইসোসায়ানেট। ১৯৮৪ সালের ২রা ডিসেম্বর রাতে কারখানার ‘সি প্ল্যান্ট’-এ সঞ্চিত মিথাইল আইসোসায়ানেটের ৬১০ নম্বর ট্যাঙ্কে কোনও ভাবে জল মিশে যায়। তাপদায়ী বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য গ্যাস। উদ্ভূত ভয়ঙ্কর তাপ ও চাপে ট্যাঙ্ক খুলে প্রায় ৪০ মেট্রিক টন মারণ মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। চোখজ্বালা, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ত্বকের প্রদাহে আক্রান্ত হন প্রায় সাড়ে আট লাখ জনবসতির ভোপালের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ।

বাতাসে মিথাইল আইসোসায়ানেটের ০.৪ পিপিএম (পার্ট পার মিলিয়ন)-এর উপস্থিতিই বিপজ্জনক। তা ২১ পিপিএম এ পৌঁছলে মৃত্যু অনিবার্য। ভোপালে এর মাত্রা পৌঁছেছিল তারও কয়েক গুণ বেশি। ফলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অসহনীয় কষ্ট নিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন প্রায় কয়েক হাজার মানুষ। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ভোপাল গ্যাসকাণ্ডে মোট মৃতের সংখ্যা ৩,৭৮৭, শারীরিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ৫,৫৮,১২৫ জন। যার মধ্যে ভয়ঙ্কর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে স্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার হন ৩,৯০০ জন।

তবে ভোপাল গ্যাসকাণ্ডের দুর্গতদের পক্ষে আন্দোলনকারীদের দাবি, অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশী। পরবর্তী এক বছরের মধ্যে আরো প্রায় পনের হাজার মানুষ প্রাণ হারান। আজো সেখানে জন্ম নিচ্ছে পঙ্গু শিশু। ওই বিপর্যয়ের পর জন্ম নেওয়া শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। তাদের অনেকে ক্যান্সার ও নানা জটিল রোগে ভুগছে। যারা বেঁচে আছেন, তাঁরা হারিয়েছেন আত্মীয় পরিজনদের। হয়েছেন পঙ্গুত্যের শিকার। বহন করছেন, শারীরিক ও মানসিক ক্ষত।
কিন্তু তারা কি পেয়েছে নায্য বিচার? বলতে গেলে নায্য বিচার আজো মেলেনি। সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যান, ওয়ারেন অ্যান্ডারসন দুর্ঘটনার কয়েকদিন পরই কারখানা দেখতে ভূপালে গেলে তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই জামিন পেয়ে যায়। তড়িঘড়ি ভারত ত্যাগ করেন। কি করে সে ভারত ত্যাগ করতে পারল, সেটিও একটি রহস্য। কারণ, তাকে সরকারিভাবে ‘পলাতক’ ঘোষণা করা হয় এবং ভারত সরকার তাকে বিচারের জন্য ভারতে নিয়ে আসতে আমেরিকার ওপর সেভাবে কখনও চাপ প্রয়োগ করেনি। অ্যান্ডারসন 2014 সালে সেপ্টম্বর মাসে মারা যায়।

ক্ষতিপূরণ নিয়ে যে দীর্ঘমেয়াদি আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়, তা’তে ইউনিয়ন কার্বাইড, ভারত সরকার এবং মার্কিন সরকার, তিন পক্ষই সংশ্লিষ্ট ছিল৷ ১৯৮৫ সালেই ভারত সরকার আইন করে, সরকারকে ভোপাল দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের একমাত্র প্রতিনিধি বলে ঘোষণা করে৷ ১৯৮৬ সালের মার্চে ইউনিয়ন কার্বাইড ৩৫ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়৷ ভারত সরকার 3.3 বিলিয়ন ডলার দাবি করে। কিন্তু 1989 সালে ভারত সরকার মাত্র 47 কোটি ডলারের বিনিময়ে সমঝোতা করে নেই। ভূপালের লক্ষ লক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এটাকে সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করে। তারা আজো ক্ষতি পূরণের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। তাঁদের জন্যই বোধহয় সেই প্রবাদ বাক্যটি, “বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে।” এখন দেখার বিষয়, বিশাখাপত্তনমের ভাগ্যে কি জোটে।